এইচএমভির মহড়াকক্ষ। কাজী নজরুল ইসলামের সামনে গাইছেন এক খুদে গায়িকা। বয়স বড়জোর ১০ বছর। গান শুনে মুগ্ধ নজরুল। শিল্পীকে বললেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কেমন করে?’ তাঁর জবাব, ‘নিজে নিজেই। কালো কালো রেকর্ড শুনে।’
অবাক হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কমল দাশগুপ্তসহ উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘কত খুশির দিন, বল তো। এইচএমভির রিহার্সাল রুমে একটা মুসলিম মেয়ে। দেখিস, এই মেয়ে কিন্তু নাম করবে।’
ফিরোজা বেগম শুধু নাম করেননি। নজরুলসংগীত ও ফিরোজা বেগম এক হয়ে গেছে। সেই ফিরোজা বেগমের গান ও জীবন নিয়ে তৈরি করা হলো আর্কাইভ। আজ বুধবার শিল্পীর ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে উদ্বোধন হলো এই আর্কাইভ।
www.ferozabegum.com নামের এই ডিজিটাল আর্কাইভে থাকছে তাঁর সংগীত, সাক্ষাৎকার, তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদনসহ দুর্লভ সব সংগ্রহ। ফিরোজা বেগমকে নিয়ে এই আয়োজন করেছে এসিআই ফাউন্ডেশন।
উদ্বোধনী আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘ফিরোজা বেগম আজীবন একনিষ্ঠভাবে নজরুলসংগীত সাধনা করেছেন। ফিরোজা বেগম নজরুল দর্শনকে শুধু আত্মস্থই করেননি, এর প্রচারও করেছেন। সারা বিশ্বে নজরুলের গানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই উদ্যোগকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।’
ফিরোজা বেগমের সহোদর ও এসিআই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অনুষ্ঠান সঞ্চালক সাদিয়া আফরিন মল্লিক তাঁর বক্তৃতা পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘শিল্পী ফিরোজা বেগমের ঐশ্বরিক কণ্ঠ এবং তাঁর একাগ্র সাধনায় নজরুলসংগীত এই উপমহাদেশে জনপ্রিয় করে তোলেন। এ মহান শিল্পীর জীবন ও কর্মের অনেকটাই এই আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। অনুরোধ করব, কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন থাকলে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবেন। আমরা সম্মানের সঙ্গে তা এই আর্কাইভে সংরক্ষণ করব।’
বিশেষ অতিথি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ফিরোজা বেগমকে নিয়ে বলেন, ‘নজরুলসংগীত এবং ফিরোজা বেগম একাকার হয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। আনিস উদ দৌলাকে শ্রদ্ধা জানাই। এটা একটা বড় কাজ। এটা দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হবে। আমরা সবাই এই আর্কাইভের সঙ্গে থাকব। সহযোগিতা করব।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় সাংসদ ও সাস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমরা কোনো কিছুই সংরক্ষণ করি না। ফিরোজা আপার গান যদি হারিয়ে যায়, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হবে। আমরা এ ধরনের কাজগুলো যদি আরও বেশি করি, তাহলে আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারব।’
এ ছাড়া শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, ফেরদৌসী রহমান, ফিরোজা বেগমের ভাই সাবেক সচিব ও গীতিকার মোহাম্মদ আসাফ উদ দৌলাহ্, ছেলে শাফিন আহমেদ স্মৃতিচারণা করেন। ভার্চ্যুয়াল এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে এই শিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন শিল্পী অনুপ ঘোষাল। ভিডিও শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান আরতি মুখার্জী, হৈমন্তী শুক্লা, শ্রীকান্ত আচার্য প্রমুখ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও অংশ নেন দুই বাংলার সংগীতশিল্পীসহ ফিরোজা বেগমের সুহৃদেরা। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ফিরোজা বেগমকে নিয়ে সংগীত পরিচালক আজাদ রহমানের একটি ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করা হয়। মা অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি সুস্মিতা আনিস। তাঁর বক্তব্য পড়ে শোনান সঞ্চালক সাদিয়া আফরিন মল্লিক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।
ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই । তিনি পেয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুর্লভ সান্নিধ্য। স্বয়ং জাতীয় কবির কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত ৩৮০টির বেশি একক অনুষ্ঠানে গান করেছেন ফিরোজা বেগম। নজরুলসংগীত ছাড়াও তিনি গেয়েছেন আধুনিক গান, গীত, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত। এ পর্যন্ত তাঁর ১২টি এলপি, চারটি ইপি, ছয়টি সিডি ও ২০টির বেশি অডিও ক্যাসেট বেরিয়েছে।
নজরুলসংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে-বিদেশে পেয়েছেন নানা পুরস্কার—স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক, সেরা নজরুলসংগীতশিল্পী পুরস্কার, নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার ।
২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাত আটটা ২৮ মিনিটে ওই হাসপাতালেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।