করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে দেয়া কঠোর লকডাউন ঈদুল আজহার জন্য শিথিল করা হয়েছিল। বিধি-নিষেধ শিথিলের ভেতর মাত্র আটদিন গণপরিবহন চালু ছিল। তবুও এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৪০ সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৪৪৭ জন। আর সড়ক, রেল ও নৌ-পথে মোট ২৬২ দুর্ঘটনা হয়েছে। এতে ২৯৫ জন নিহত এবং ৪৮৮ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমিতির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
শুক্রবার (৩০ জুলাই) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তন হলে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২১ প্রকাশকালে এই তথ্য তুলে ধরেন।
লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত সীমিত হলেও স্বল্পসময়ের জন্য গণপরিবহন চালু করায় সড়কে গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যান বিশেষ করে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা-ব্যাটারিচালিত রিকশা, ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ডভ্যানে একসঙ্গে গাদাগাদি করে যাতায়াতের কারণে বিগত ছয় বছরের তুলনায় এবারের ঈদে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটোই বেড়েছে। ঈদযাত্রা শুরুর দিন গত ১৪ জুলাই থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ২৮ জুলাই পর্যন্ত বিগত ১৫ দিনে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন নিহত ৪৪৭ জন আহত হয়েছে।
উল্লেখিত সময়ে রেলপথে ০৯ টি ঘটনায় ১১ জন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১৩ টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ৩৬ জন আহত এবং ২১ জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে যৌথভাবে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ২৯৫ জন নিহত ও ৪৮৮ জন আহত হয়েছে। তবে ২৩ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার পর ২৫ জুলাই থেকে সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমতে থাকে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ৮৭ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত, ৫৯ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬.২৫ শতাংশ, নিহতের ৩৪.০৬ শতাংশ এবং আহতের ১৩.১৯ শতাংশ প্রায়।
এই সময় সড়কে দুর্ঘটনার শিকার ১০৬ জন চালক, ১৯ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬৪ জন পথচারী, ৩৮ জন নারী, ৩১ জন শিশু, ১২ জন শিক্ষার্থী, তিনজন সাংবাদিক, পাঁচজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১২ জন শিক্ষক, ০৬ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং একজন প্রকৌশলীর পরিচয় মিলেছে।
এরমধ্যে নিহত হয়েছে দুইজন পুলিশ সদস্য, একজন সেনা সদস্য, একজন বিজিবি, ২৭ জন নারী, ১৭ জন শিশু , ০৯ জন শিক্ষার্থী, ০৯ জন শিক্ষক, ৮৭ জন চালক, ১৬ জন পরিবহন শ্রমিক, ৫৩ জন পথচারী, তিনজন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।
সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২৮.৪৮% মোটরসাইকেল, ২৮.৭৮% ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৭.৪১% কার-মাইক্রো-জিপ, ৮.৬০% নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ১০.৩৮% অটোরিকশা, ৭.৭১% ব্যাটারী রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, ও ৮.৬০% বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৫.৮৩% মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪৪.২৫% পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা, ১৮.৩৩% নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা, ৭.৯১% অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে ও ০.৮৩% চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং ০.৮৩% ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩.৩৩% জাতীয় মহাসড়কে, ৪৩.৩৩% আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৮.৩৩% ফিডার রোডে এবং ০.৮৩% রেল ক্রসিং এ সংঘটিত হয়।
এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩.৩৩% ঢাকা মহানগরীতে, ০.৮৩% চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “বিগত ঈদগুলোতে সরকারের নানামহলের তৎপরতা থাকায় দুর্ঘটনার লাঘাম কিছুটা টেনে ধরা সক্ষম হলেও কঠোর লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত সীমিত থাকার পরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারী না থাকায় এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। সরকার সড়কের অবকাঠামোর উন্নয়নে যতটা মনোযোগী সড়ক নিরাপত্তায় ততটা উদাসীন। বিগত একযুগে ধারাবাহিকভাবে সড়ক নিরাপত্তায় নানা প্রতিশ্রুতি, নানা চমকপ্রদ বক্তব্য, নানা আশ্বাস, নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনকিছুই যেন বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখে না। এরই মধ্যে বাস্তবায়নের আগেই সড়ক আইন আরও দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। ফলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
এতে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ন মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।