দেশে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার আবারও ৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত এক দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৯০০-র কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যা গত ১৪ সপ্তাহের সর্বোচ্চ। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন দেশে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়েভ শেষে এখন তৃতীয় ঢেউ চলছে। ফলে ভাইরাসটির গণসংক্রমণ শুরু হয়েছে।
বুধবার খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির যুগান্তরকে বলেন, করোনা দেশ থেকে যায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ চারদিকে যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে তৃতীয়, চতুর্থ ঢেউ বিষয় নয়, ফের গণসংক্রমণ চলছে বলা যেতে পারে। তাছাড়া শুধু বাংলাদেশ নয়, ভাইরাসটি সারাবিশ্বেই নাস্তানুবাদ পরিস্থিতি তৈরি করছে। নতুন ধরন ওমিক্রন ছাড়াও আরও ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, মানুষ সচেতন না হলে এটি মোকাবিলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে আগামী দুই মাস যদি আমরা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তবে সবাই উপকৃত হব। এক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরা, সভা-সমাবেশ বন্ধ, ছোট পরিসরে সামাজিক অনুষ্ঠান করে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে হবে। তবেই শনাক্তের হার কমবে, রোগীরা পরিপূর্ণ সেবা পাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ১০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিভাগ আরও ২৫ জনকে সন্দেহভাজন তালিকায় রেখেছে। সীমান্তসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। যদিও সরকার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণসহ নতুন ধরন প্রতিরোধে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা মাথায় না রেখে গৎবাঁধা কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। কারণ এখনো অর্ধেকের বেশি মানুষ পূর্ণ ডোজ টিকার আওতায় আসেনি। সীমান্ত এলাকা অরিক্ষত রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও মেলা চলছে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। গণপরিবহণ, পর্যটন কেন্দ্র, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান-সবখানে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভারতে এখন পর্যন্ত ২১৩৫ জনের দেহে ওমিক্রন সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাদের মধ্যে মহারাষ্ট্রে ৬৫৩ জন এবং রাজধানী দিল্লিতে ৪৬৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে ভারতে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও দিন দিন শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এতে সহজেই বলা যায়, দেশে গণসংক্রমণ শুরু হয়েছে।
বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিকে তৃতীয় ঢেউ বা গণসংক্রমণ দুটোই বলা যায়। কারণ নতুন ধরন ওমিক্রন খুবই সংক্রামক। এটি দ্রুত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে ৪৯ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। বুধবার একদিনে ৯ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও এটি চলে এসেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় গুচ্ছ সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এটা আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে মোকাবিকলার জন্য জোর প্রস্তুতির প্রয়োজন। সরকারের আগের যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেখান থেকে কাটছাঁট করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
বুধবার মহাখালীর অনুষ্ঠানে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল না দেওয়ার আহ্বান জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ বাড়ছে, মানে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আছে। তবে কোন ধরন ছড়াচ্ছে, সেটার পেছনে না ছুটে এখনই সবাইকে সতর্ক হওয়া উচিত। সংক্রমণ যেন আবারও দ্রুত না ছড়ায় এবং সেটি মহামারি আকার ধারণ না করতে পারে। সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে নতুন তফসিল না দেওয়ার অনুরোধ জানাই।’
এদিকে বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৮৯২ জনের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর চেয়ে বেশি রোগী এক দিনে শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ ২৯ সেপ্টেম্বর। সেদিন ১১৭৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার খবর এসেছিল। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮০৭ জনে।
এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৯০ জন। মঙ্গলবার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। বুধবার তা বেড়ে ৪ দশমিক ২০ শতাংশ হয়েছে। এর বেশি শনাক্তের হার সর্বশেষ ছিল গত ২৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন প্রতি ১০০টি নমুনা পরীক্ষায় ৪ দশমিক ৪৮ জনের করোনাভাইরাস পজিটিভ এসেছিল।