জ্বালানি তেলের ‘আগুনে’ পুড়ছেন সাধারণ মানুষ। হু হু করে বাড়ছে প্রতিটি পণ্যের দাম। চাল-ডাল, তেল, মাছ-মাংস, পেঁয়াজ-মরিচসহ সব ধরনের সবজি কিনতে ক্রেতার নাভিশ্বাস। এর মধ্যে একদিনের ব্যবধানে আরও ৫ টাকা বেড়ে প্রতি হালি ডিম ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি আরও ১০ টাকা বেড়ে ঠেকেছে ২২০ টাকায়। আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে না পেরে মানুষ এখন দিশেহারা। নিদারুণ কষ্টে আছেন তারা। সংসার সামলাতে হাত পড়েছে সঞ্চয়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো প্রতিটি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করলেও তা দেখার যেন কেউ নেই। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালালেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের হুঁশিয়ারি কানেই নিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। মনিটরিং এবং সমন্বয়ের অভাবে সবকিছুর দাম পাগলা ঘোড়ার মতো বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই বাজার ও পরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
করোনা মহামারিতে কাবু হয়েছেন সব পেশার মানুষ। আয় কমে যাওয়ায় টানাপোড়েনে চলছে সাধারণ মানুষের সংসার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও পড়েছে। এমন সংকটের মধ্যেই রেকর্ডমূল্য বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের। যার প্রভাব পড়ছে নিত্যপণ্যসহ প্রতিটি খাতে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ৩৯টি পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করলেও বাজারের সঙ্গে মিল নেই। মূল্য কমাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরও যেন নির্বিকার। দায় নিচ্ছে না কেউ। সঙ্গে লোক দেখানো ও সমন্বয়হীন বাজার তদারকিতে পণ্য কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো সুফল নেই। পরিস্থিতি এমন-যেন টিকে থাকাই দায়।
সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পণ্য পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু কি পরিমাণে ভাড়া বাড়বে সেদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই পরিবহণসংশ্লিষ্টরা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। পাশাপাশি পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোনো রোডম্যাপ তৈরি করা হয়নি। এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু বিক্রেতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পরিবহণ ব্যয় বাড়ার অজুহাতে কেজিপ্রতি পণ্যের দাম যেখানে ৫০ পয়সা থেকে দেড় টাকা বা দুই টাকা বাড়ার কথা, সেখানে ৫-২০ টাকা বাড়িয়ে পণ্য বিক্রি করছে। যা খতিয়ে দেখতে মাঠপর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে না। এতে সাধারণ ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া সরকারের তিনটি সংস্থা-ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশন বাজারে পণ্যমূল্য তালিকা তৈরি করে। তবে এই তিন সংস্থার তালিকা বাজারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ মিল নেই। ফলে ক্রেতারা কোনো সুফল পাচ্ছেন না।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই বাজারে পণ্যমূল্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে সব ধরনের পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। তবে কি পরিমাণ বাড়ার কথা বা কি পরিমাণে বেড়েছে তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর যেন নির্বিকার। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। সব মিলে ভোক্তা স্বার্থ উদ্ধারে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে। তবে দেখা গেছে, বাজারে বেশ কয়েকটি সংস্থা তদারকি করে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাই সমন্বয় রেখে অনিয়ম পেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। তাই চালক ও মালিক তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। এছাড়া এই সুযোগে কিছু অসাধু বিক্রেতা সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়াতে পারে। তাই পণ্য পরিবহণে কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। তখন নির্দিষ্ট ভাড়ার বেশি আদায় করা যাবে না। তবে সরকার আমাদের এ পরামর্শ আমলে নেয়নি।
সম্প্রতি ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে এ খাতের আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীরা। তবে সরকার এ ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত না নিলেও তারা বাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। রোববার খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৮৫-১৯০ টাকা। যা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে ১৬৬ টাকা ও টিসিবির দৈনিক পণ্যমূল্য তালিকায় ১৭৫ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টিসিবির দৈনিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকায় প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম দেওয়া আছে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের যৌক্তিক খুচরা মূল্য সর্বোচ্চ ১৯০ টাকা। আর সিটি করপোরেশনের পণ্যমূল্য তালিকায় দাম ১৮৫-১৯০ টাকা। তবে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি সর্বোচ্চ ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা একদিন আগেও ২১০ টাকা ছিল। আর গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১৭০ টাকা। আর টিসিবির মূল্য তালিকায় প্রতি হালি (চার পিস) ফার্মের ডিমের দাম দেওয়া আছে ৫০-৫৫ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকায় দেওয়া ৪৪-৪৮ টাকা। তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা। যা একদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ৪২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি টিসিবির মূল্য তালিকায় প্রতি কেজি নাজিরশাইলের মূল্য দেওয়া আছে ৮০ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ ৮১ টাকা। সিটি করপোরেশনের তালিকায় ৬৮-৮১ টাকা, তবে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ ও বাজার তদারকি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আ. গাফ্ফার খান বলেন, অধিদপ্তর তদারকি টিম প্রতিদিন বাজারে যাচ্ছে। আমি নিজেও বাজার তদারকি করছি। ইতোমধ্যে কাঁচামরিচসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। পাশাপাশি আমরা তথ্য সংগ্রহ করে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছি। ওই মূল্যে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা দেখতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, টিসিবি বাজার তদারকি করে না। তবে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনা ও বাজারে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে। পাশাপাশি সরেজমিন বাজারে গিয়ে পণ্যের মূল্য তালিকা তৈরি করা হয়। বাজারে পণ্যের দামের সঙ্গে তালিকায় মিল নেই এটা বলা যাবে না। কারণ, অনেক সময় একেক বাজারে একেক দামে পণ্য বিক্রি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনিয়ম সামনে এলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি জানান, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। ওই দাম যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা ব্যবসাবান্ধব ও ভোক্তাবান্ধব পরিবেশ চাই। তবে কেউ কারসাজি করলে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তবে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও এখন অস্থির সময় পার করছে। অধিদপ্তর যতই চেষ্টা করুক না কেন, দাম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ। সূত্রঃ যুগান্তর