উদীয়মান ক্রিকেটার সাকিব মাহমুদুল্লাহ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন প্রায় অন্ধ হওয়ার পথে। তিনি যে কেবল চোখের আলো হারাতে বসেছেন তাই নয়, ক্রিকেট হওয়ার স্বপ্নও তার মুছে যাচ্ছে। তিনি দানের টাকা চান না, চিকিৎসা সহায়তা চান। চোখের আলোটুকু কেবল ফিরে পেতে চান।
রংপুর কারমাইকেল কলেজের অনার্স ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র সাকিব মাহমুদুল্লাহ(২০)। জেলার সৈয়দপুর উপজেলার কাজীপাড়া নিবাসী আকবর আলী ও আছিয়া খাতুন দম্পতির পুত্র তিনি। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট সাকিব। পেশায় মাংস ব্যবসায়ী আকবর আলী ভালোবাসতেন ক্রিকেট। সেই ভালোবাসাকে প্রোথিত করেছিলেন ছোট ছেলে সাকিবের হৃদয়ে। অবসর পেলেই সাকিবকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এ মাঠ থেকে ও মাঠে। ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন দূর দূরান্তে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন সাকিব। ১৮ জুলাই সৈয়দপুরে বন্ধুদের সাথে মিছিলে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময় মিছিলে পুলিশের গুলিতে শরীরের বিভিন্ন স্থানসহ দুই চোখেও গুলি লাগে। বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে সৈয়দপুর ১০০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি করান। এরপর রংপুর ও ঢাকার একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কিন্তু বাম চোখে আর আলো ফিরে আসেনি। এখন ডান চোখেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন না। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বিজয় হয়েছে ছাত্র-জনতার। দেশের আপামর মানুষ সে আন্দোলনের সুফল পেতে শুরু করেছে। কিন্তু দিনে দিনে অন্ধকার হয়ে আসছে সাকিবের পৃথিবী।
সাকিব বাসসকে বলেন, ‘দান হিসেবে কোন টাকা পয়সা চাই না। শুধুমাত্র চিকিৎসা সহযোগিতা চাই। চোখের আলো ফেরত চাই। আবার ক্রিকেটের মাঠে ফিরতে চাই। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
জানা যায়, সাকিবের বাবা ছেলেকে ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এজন্য ছেলের নাম রেখেছিলেন সাকিব মাহমুদুল্লাহ। ছোটবেলা থেকে ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন শহর-গ্রামের একাধিক ক্রিকেটের মাঠ। যেভাবেই হোক তৈরি করবেন ছেলেকে। ছেলে একদিন জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলবে এটাই ছিলো স্বপ্ন। খেলার মাঠে খানিকটা পোক্ত হতেই বাবা মারা গেছেন ২০১৭ সালে। কিন্তু সাকিবের স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বাবার দেখানো পথে এলাকার বিভিন্ন মাঠে খেলে ইতোমধ্যেই ক্রিকেটের আসরে কুড়িয়েছেন অনেক সুনাম। এরপর দূর-দূরান্তের বিভিন্ন মাঠে ডাক পড়তে শুরু করে তার। এমন ডাকে খানিকটা আয়ও আসতে শুরু করে। খেলার আয়েই চলতো নিজের লেখাপড়ার খরচ। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলি এলোমেলো করে দিয়েছে সাকিবের শৈশবের লালিত স্বপ্ন। গুলির আঘাতে আহত হয়ে হারিয়েছেন বাম চোখের আলো। ডান চোখও এখন নষ্ট হওয়ার পথে।
সাকিব মাহমুদুল্লাহ বাসসকে জানান, তার বাবার মৃত্যুর পর বড় দুই ভাই আকতার কোরাইশি এবং তাজুল হাসান সংসারের হাল ধরেন। তারাও পেশায় মাংস ব্যবসায়ী। সাকিব ক্রিকেট খেলে নিজের পড়ার খরচ যোগাড় করতেন। জেলা ক্রিকেট দলে প্রথম বিভাগে বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে খেলতেন তিনি। এখন চোখের আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে অর্থাভাবে শিক্ষাজীবনও থেমে যাবে হয়তো তার।
সাকিবের বড় ভাই আকতার কোরাইশি জানান, বাংলাদেশ চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক সঞ্জয় কুমার দাসের ত্বত্তাবধানে চিকিৎসা চলছে সাকিবের। অপারেশনে তার বাম চোখে থাকা ছররা গুলি বের করা সম্ভব হলেও রেটিনার অংশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করালে চোখের আলো ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে। এখনো তার মাথা থেকে আটটি, নাকে একটি ও চোয়ালে একটি বিঁধে থাকা ছররা গুলি বের করা যায়নি।
তিনি আরো জানান, ‘চিকিৎসকরা বলেছেন দেশে তার চিকিৎসা নেই। দেশের বাইরে নিয়ে গেলে চোখ বাঁচানো যেতে পারে। এজন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। সে টাকা পরিবারের পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব না’।
সাকিবের মা আছিয়া খাতুন বলেন,‘অনেক তাজা জীবনের বিনিময়ে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো, সেই স্বাধীন দেশে আজ আমার ছেলে দেখতে পাবেনা তা মানতে পারছি না। ছেলের চোখের আলো ফিরে পেতে সরকারসহ দেশের মানুষের সহযোগিতা চাই’।
সৈয়দপুর উপজেলার সাবেক ক্রিকেটার মোক্তার সিদ্দিকী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে সাকিব আমার কাছে মাঠে অনুশীলন করে। সে আমার সিটি ক্রিকেট ক্লাবের নিয়মিত একজন খেলোয়াড়। এখন তাকে মাঠে ফেরাতে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষে সে ভার বহন করা সম্ভব না।’ তিনি সাকিবের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে সরকার ও প্রশাসনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বাসসকে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের তালিকা হাসপাতাল থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। নীলফামারী জেলা থেকেও একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের কাছে এখনও কোনো দিক নির্দেশনা আসেনি। তবে সাকিবের পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্রসহ যোগাযোগ করা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।