আগামী মাসে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে সরকারের শিক্ষাসংশ্নিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ে নানা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রতি দু'দিন পরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্ন করতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বস্তরের শিক্ষকদের টিকাদান কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার কাজও চলছে জোরেশোরে।
স্কুলগামী শিশুদের আপাতত না হলেও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর সারাদেশের চার লাখ ৪০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের টিকা দেওয়ার কাজটি আগামী ১১ আগস্টের মধ্যে শেষ করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এর আগে আরও দুইবার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েও করোনার সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যায়নি। সে কারণে এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আগাম কোনো ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে না। সূত্রমতে, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে, একসঙ্গে খুলে দেওয়া হবে না। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে এবং আটকে থাকা স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলো আগে নেওয়া হবে। এরপর ধাপে ধাপে কলেজ ও বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ কমে এলে সেপ্টেম্বর থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা স্কুলগুলো খুলে দিতে চাই। সরাসরি ক্লাস শুরু করা খুব দরকার। জুম ও গুগলমিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক দরিদ্র ও অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও পড়ে। তাদের সবার কাছে এই পাঠদান পৌঁছানো যাচ্ছে না। এটিই বাস্তবতা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তদারকিতে প্রাথমিক শিক্ষকরা বেশিরভাগই কভিড-১৯-এর টিকা নিয়েছেন।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ পর্যন্ত মোট ২২ বার এ ছুটি দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। টানা ১৭ মাস ধরে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী হাত গুটিয়ে ঘরে বসে। ঘরবন্দি ছাত্রছাত্রীরাও ক্লাসরুমে দ্রুত ফিরতে চায়, ফেলতে চায় স্বস্তির নিঃশ্বাস।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিষয়টি মাথায় রেখেই সেপ্টেম্বরে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে, আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সীমিত পরিসরে কেবলমাত্র তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে এ দুটি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। সময় ও নম্বর কমিয়ে গ্রুপভিত্তিক (বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যসহ অন্যান্য গ্রুপ) তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আবশ্যিক কোনো বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে না। তবে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে আবশ্যিক বিষয় এবং চতুর্থ বিষয়ের নম্বর দিয়ে ফলাফলে যোগ করা হবে। আর জেএসসি ও সমমান এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে আবশ্যিক বিষয় ও চতুর্থ বিষয়ের নম্বর দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর অনুযায়ী চতুর্থ বিষয়ের নম্বর সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা-২০২১-এর ফলাফলে নম্বর দেওয়া হবে। সরকারের ভাবনা হলো, সেপ্টেম্বরে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া সম্ভব হলে এ দুই পাবলিক পরীক্ষার ৪৪ লাখ পরীক্ষার্থী অন্তত আড়াই থেকে তিন মাস সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ পাবে। এতে তাদের শিখন ঘাটতি অনেকটা মেটানো যাবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক বেলাল হোসাইন জানান, মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি চিঠি দিয়ে প্রতি দু'দিন অন্তর বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ক্লাসরুম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা সেটি করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকাদান দ্রুত সম্পন্ন করা। শিক্ষকদের টিকাদান ইতোমধ্যে সম্পন্ন প্রায়। আগস্টজুড়ে টিকার বাইরে থাকা প্রায় ৮৪ হাজার বেসরকারি শিক্ষককে টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করা হবে। ৭ আগস্ট শিক্ষা সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, সরকারি পর্যায়ের 'শতভাগ শিক্ষকই' টিকা নিয়েছেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন লাখ ৬৩ হাজার ২২২ শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে টিকা নিয়েছেন দুই লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন। বাকি আছেন প্রায় ৮৪ হাজার জন।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ হাজারের বেশি শিক্ষক টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন, তাদের মধ্যে টিকা নিয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি। দীপু মনি বলেন, আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই সব শিক্ষকই টিকা নিয়ে নেবেন আশা করা হচ্ছে।
সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আগে সব আবাসিক শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, টিকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক লাখ ৭৯ হাজার ২৬১ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৯১৪ জন। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ছয় হাজার ৭২ জন।
তবে এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকাদানের বিষয়টি গোলমেলে অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, এনআইডি থাকা আবাসিক শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করে সারাদেশে পছন্দের কেন্দ্র থেকে টিকা নিচ্ছেন। তাদের টিকা দেওয়া শেষ হলেই অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া শুরু হবে। অনাবাসিক শিক্ষার্থী যারা প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে, তাদের অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। কারণ, তাদের সবেমাত্র ১৮ বা ১৯ বছর বয়স হয়েছে। তাই আমরা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড নম্বরের মাধ্যমে টিকা দেওয়া যায় কিনা, সে ব্যাপারেও আলাপ-আলোচনা করছি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন অফিসে বিশেষ হেল্প লাইন চালু করা হয়েছে। তারা সেখানে গিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে এনআইডি নিতে পারবেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে।